বাংলাদেশ কায়েমই গুল আকবর কাকার মহব্বতের সর্বনাশ ডাকছে
গুল আকবর পাকিস্তানি ফৌজে সিপাহী (সৈনিক) পদে ছিল এবং তার পোস্টিং মাশরেকী (পূর্ব) পাকিস্তানে ছিল। সেখানে তার একটি বাঙ্গালী মেয়ের সাথে মোলাকাত হয়।
১৯৭১ সালে কলকাতায় মাশরেকী পাকিস্তান থেকে আগত মুহাজির (ফাইল ফটো, এএফপি)
নাহিদ জাহাঙ্গীর
জুমাবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২
ইন্ডিপেন্ডেন্ট উর্দু
তরজমা: ফয়সাল ইকবাল
বাংলাদেশ কায়েম স্রেফ পাকিস্তানের দুই হিস্যাকেই ভাঙ্গে নাই, অনেক মানুষের দিলরেও ভাইঙ্গা খান খান করে দিছে। পেশোয়ারের গুল আকবর কাকা তাদেরই একজন, যারা সেইদিন তাদের বাচ্চা ও জোয়ান বিবিকে চিরতরে আলবিদা জানাইয়া পাকিস্তানে চলে আসছিলেন।
আজ হইতেছে ইতিহাসের তথা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর সেইদিন, যেইদিন সবকিছু ভাগ হয়ে গেল। যা কয়েক মাস আগে ভাবাও যাইত না, তা-ই আচানক হয়ে গেল। এতে প্রভাবিত হইছে লাখো মানুষ; কিন্তু আজ আমরা আপনাদেরকে খাসভাবে এক সিপাহীর কাহিনী শুনাইতেছি।
আপনি যদি কোথাও কিছু সময়ের জন্য আরাম করতে বসেন, সেই জায়গাটা ছেড়ে আসতেও কত তকলীফ হয়, আর যখন বছরের পর বছর গুজার করার পর ঘর-বাড়ি, নিজের কলিজার টুকরারেও ছেড়ে আসতে হয়, সেটার যন্ত্রণা ও বেদনা শুধু সেই ভুক্তভোগীই এহসাস করতে পারে।
আমরা এই কিসসা পেশোয়ারের তুরবাবার বাসিন্দা গুল আকবর কাকার জবানে শুনতাম, যিনি ১৯৭১ সালে সাবেক মাশরেকী পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) থাকতেন। তিনি ফৌজে (আর্মিতে) চাকরী করতেন এবং সেখানেই তার পোস্টিং ছিল।
আমার এটাও জানা নাই যে তিনি বাংলাদেশের কোন শহরে থাকতেন, তবে কিছুদিন আগে শুনলাম যে গুল আকবর কাকা ইন্তেকাল করছেন, তাই খুব আফসোসের সাথে তার বলা কথাগুলা ইয়াদ আসতেছে। এজন্য দিলে এই খেয়াল উদয় হইল যে যেই জিনিসগুলা গুল আকবর কাকাকে হামেশা তকলীফ দিত তা নিয়া লেখি।
যখনই তিনি কথা বলতেন আর বিবি-বাচ্চাদের কথা ইয়াদ করতেন, তার শব্দমালা ও আওয়াজ থেকে যে বেদনা অনুভূত হইত, আমি আজও তা অনুভব করি।
গুল আকবর পাকিস্তানের পেশোয়ারের বাসিন্দা ছিলেন এবং পাকিস্তানী ফৌজে সিপাহী হিসাবে চাকরী করতেন। চাকরীর শুরু থেকেই মাশরেকী পাকিস্তানে পোস্টিং ছিল। এখানেই এক বাঙ্গালী মেয়ের সাথে তার মোলাকাত হয়। আস্তে আস্তে সেই মোলাকাত জ্যামিতিক হারে বাড়তে বাড়তে মোড় নিল মহব্বতে। কিছুকাল পর উভয়ে শাদী করে নেন।
গুল আকবর দুই-তিন দফায় বিবিকে পেশোয়ারে এনে নিজের ফ্যামিলির সাথে সাক্ষাত করাইছিলেন। তাঁর বিয়ে-শাদীর উপর খান্দানওয়ালাদেরও কোন এতেরাজ বা আপত্তি ছিল না। এইজন্য তিনি বিয়ে-শাদীর মামলায় আকছার নিজেকে খোশনসীবই ভাবতেন। কিন্তু কুদরতের ইশারা ছিল ভিন্ন।
বিয়ের পর তিনটা বছর কীভাবে গেল তিনি টেরই পাইলেন না, আবার ইতিমধ্যে আল্লাহ পাক এক বেটা আর এক বেটিও দান করলেন। তবে ‘খুশী’ নামক বস্তুটি তার জিন্দেগীতে কয়েক বছরের মেহমান ছিল মাত্র।
৭১ সালে যুদ্ধ ছড়িয়ে গেল, পরিশেষে মাশরেকী পাকিস্তান বর্তমান পাকিস্তান থেকে চিরতরে আলাদা হয়ে গেল। পাকিস্তানের এই বিভাজন ভারত ভাগের মত এক লহমায় রক্তের সম্পর্ককে নির্মমতার সাথে বিভক্ত কইরা দিল। গুল আকবর না চাওয়া সত্ত্বেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে মজবুর ছিলেন।
গুল আকবর বলতেন যে তিনি সেই রাতের কথা কখনও ভুলতে পারবেন না যখন তিনি কাঁপা-কাঁপা ঠোটে ও থরথর করে কাঁপা হাত দিয়ে এমন কাজ করতে যাইতেছিলেন, যা ভাবতে গেলেও কোন প্রেমিকের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠবে।
তিনি বলেছিলেন, “আমি তাকে বহুত বুঝাইছিলাম যে আমি এমনটা করব না; কিন্তু আমি তাকে আজীবন কয়েদ করে রাখতে চাচ্ছিলাম না। কারণ, তার দেশ তার কাছে প্রিয় ছিল এবং সে পাকিস্তানে আসতে চাচ্ছিল না। আবার আমি সেখানেও থাকতে পারতাম না। কেননা, একদিকে মাগরেবী (পশ্চিম) পাকিস্তানে আমার বৃদ্ধ আব্বা-আম্মা বেচাইন হয়ে আমার ইন্তেজারে ছিল। আরেকদিকে আমি ফৌজে চাকরী করতাম, চাকরী ছাইড়া বাংলাদেশে থাইকা গিয়া (নিজেকে) ‘পলাতক সিপাহী’ হিসাবে আখ্যা দিব, এও আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অগত্যা পাকিস্তানেই আসতে হল।”
গুল আকবর বাংলাদেশে অবস্থানের সেই শেষ রাতে নিজের জানের ‘মহব্বত’কে তিনবার তালাক বলে তামাম জিন্দেগীর জন্য ছেড়ে দিয়েছিল, আর নিজের শুয়ে থাকা বাচ্চাদের কপালে শেষবারের মত চুমু এঁকে আজীবনের জন্য ‘খোদা হাফেজ’ বলে চলে এসেছিল।
কিছুকাল পর্যন্ত চিঠি মারফত হালচাল জানা হত; কিন্তু ধীরে ধীরে চিঠির সেই সিলসিলাও খতম হয়ে গেল, অবশেষে সম্পর্কের বাঁধনও চিরতরে ছুটে গেল।
গুল আকবর কাকার সাথে যখনই বিভাজনের কথা হত তিনি উদাস হয়ে যেতেন আর বলতেন, “এই বিভাজন শব্দটার প্রতিই আমার চরম ঘৃণা, এই শব্দ আমার দুনিয়া থেকে শান্তি উজাড় কইরা দিছে।”
গুল আকবরও ৭১ সালে দেশপ্রেমের উপর নিজের প্রেমকে কুরবানী দিয়াছেন এবং নিজের দেশ ও শহর পেশোয়ারে এসে আরেকটা শাদী করে নয়া সুরতে জিন্দেগী গুজরান শুরু করছেন।
আজ গুল আকবর কাকাও এই নশ্বর দুনিয়া থেকে বিদায় নিছেন, আর তাঁর বছরের পর বছর জিইয়ে থাকা মহব্বতও তাঁরই সাথে চিরতরে দাফন হয়ে গেছে।